বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০১:১৪ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
শুরুতেই জেনে নিই প্রিয়েমশন কি? অগ্রক্রয় বা প্রি-এমশন শব্দের শাব্দিক অর্থ হলো, অন্যদের চেয়ে একজনের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ক্রয় করার অধিকার। মুসলিম আইনে অগ্রক্রয়কে সাফা বলে । একটি উদাহরণ দিলেই আপনাদের কাছে বিষয়টি আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। ধরুণ রেজাউল, মিলন ও লিটন তিন ভাই। ভাইদের মধ্যে সদ্ভাব নেই। লিটন দেনা শোধ করার জন্য সে তার বাড়ির জমি থেকে দশ শতাংশ জমি বেচে দেবে। লিটন পশ্চিম পাড়ার লোকমানের কাছে জমি বেচার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিছুতেই সে ভাইদের কাছে জমি বেচবে না। ভাইয়েরা যাতে মামলা করে সুবিধে করতে না পারে সেজন্য দলিলে জমির দাম বেশি উল্লেখ করে রেজিস্ট্রি করেছে।
বাপ-দাদার ভিটার জমি অন্য লোকে বাইরে থেকে এসে কিনে নিবে তা বড় ভাই রেজাউল কিছুতে সহ্য করতে পারে না। রেজাউল শুনেছে শরিকদের জমি কেনার জন্য তারা আইন অনুযায়ী অগ্রাধিকার পাবে। বাইরের লোক যদি কোন জমি কিনে নেয় তবে দেওয়ানি আদালতে মামলা করে সেই জমির দাম তাকে ফেরত দিয়ে জমি নিয়ে নেয়া যায়। এই মামলাকে অগ্রক্রয় বা প্রিএমশন মামলা বলে।
কাজেই অগ্রক্রয় বা প্রিএমশন হচ্ছে কোন মালিকের তার অংশীদার বা পার্শ্ববর্তী জমির মালিক কর্তৃক অন্য কারও কাছে বিক্রি করা জমি বিক্রয় মূল্য ফেরত দিয়ে পুণ:কেনার অধিকার। জমি দাম অনুযায়ী সহকারী জজ বা যুগ্ম জেলা জজ কোর্টে মামলা করে এই অধিকার আদায় করা যায়। দেওয়ানি আদালতে মামলা করে রেজাউল বা মিলন এই অধিকার আদায় করতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে কৃষি ও অকৃষি জমির ক্ষেত্রে অগ্রক্রয় আইনে কিছু পার্থক্য আছে। অকৃষি জমি বলতে সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা শহর এলাকার জমি বুঝায়। এছাড়া অন্য অঞ্চলের আবাসিক বা শিল্প-বাণিজ্য কাজে ব্যবহৃত জমিও অকৃষি জমি। বাদবাকি অন্যান্যা চাষাবাদের জমি কৃষি জমি। অকৃষি জমির ক্ষেত্রে রেজাউলের মত শরিক সূত্রে মালিক হলে তাদের অগ্রক্রয়ের অধিকার সবার আগে। এরপর কেনার মাধ্যমে যারা শরিক হয় তারা অগ্রাধিকার পাবে।
কিন্তু পার্শ্ববর্তী সংলগ্ন জমির মালিক কোন সুযোগ পাবে না। কৃষি জমির ক্ষেত্রে ক্রয় এবং উত্তরাধিকার সূত্রে মালিক ছাড়াও পার্শ্ববর্তী সংলগ্ন জমির মালিক অগ্রাধিকার পাবে। রেজাউল সহকারী জজ কোর্টে মামলা করে প্রকৃত মূল্য ফেরত দিয়ে লোকমানের কাছে বিক্রি করা জমি ফেরত পেতে পারে। লোকমান দলিলে বেশি দাম উল্লেখ করে রেজিস্ট্রি করলেও প্রকৃত বিক্রিত টাকা এবং কৃষি জমি হওয়ার কারণে শতকরা ১০ টাকা হারে ক্ষতিপূরণ ফেরত দেওয়ার আদেশ দিতে পারে। অকৃষি জমির অগ্রক্রয় মামলা করতে হলে দলিলে যে দাম উল্লেখ থাকে সেই টাকা ছাড়াও আরো শতকরা ৫ টাকা আদালতে জমা দিতে হয়। কৃষি জমির ক্ষেত্রে এই হার শতকরা ১০ টাকা। অগ্রক্রয়ের আদেশ দেয়া হলে এই টাকা ক্রেতাকে ফেরত দেয়া হয়।
প্রিএমশন মামলা দায়ের করতে হলে আইন অনুযায়ী সম্ভাব্য ক্রেতাদের পক্ষভূক্ত করতে হয়। মামলা দায়ের হলে এদের উপর নোটিশ জারি হয়। কেউ পক্ষভূক্ত হতে চাইলে তাকে পক্ষভূক্ত করা হয়। অতঃপর জজ সাহেব সাক্ষ্য প্রমাণ নিয়ে ক্ষতিপূরণসহ কেনা দাম ক্রেতাকে ফেরত দিয়ে শরিক, ক্রয়সূত্রে মালিক বা পার্শ্ববর্তী মালিকের নামে দলিল রেজিস্ট্রি করার আদেশ দিতে পারেন। জজ সাহেব শুনানি করার পর যদি প্রমাণ হয় আইন অনুযায়ী অগ্রক্রয়ের অধিকারীরা যাতে কিনতে না পারে সে জন্য যত টাকা লেনদেন হয়েছে দলিলে তার চেয়ে আরও বেশি টাকা দাম লেখা হয়েছে তবে সেই টাকা বাদ দিয়ে বাকি টাকা ক্রেতাকে ফেরত দেয়ার আদেশ দিতে পারে।
একইভাবে জমি কেনার পর ক্রেতা ভূমি উন্নয়ন কর, মাটি ভরাট, বিদ্যুত লাইন, দেনা পরিশোধ ইত্যাদি উন্নয়নের ব্যাপারে কোন খরচ করলে সেই টাকাও ক্রেতাকে ফেরত দেয়ার আদেশ দিতে পারে। এছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে অগ্রক্রয় মামলা করার কোন অধিকার নেই। উত্তরাধিকার সূত্রে শরিক যদি কোন জমি কেনে তবে তার বিরুদ্ধে অগ্রক্রয় মামলা করা যায় না। বিনিময় বা ভাগ-বাটোয়ারা করা হলেও অগ্রক্রয় হয় না। যাদের ৬০ বিঘা জমি আছে তারা অগ্রক্রয়ের অধিকার পাবে না। ৬০ বিঘার কম জমি থাকলে ৬০ বিঘা পূরণ করতে যে পরিমাণ জমি লাগে সর্বাধিক সেই পরিমাণ জমি অগ্রক্রয়ের মামলা করে পেতে পারে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮